ভারতে জন্ম সনদ এতদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি হলেও, তা একমাত্র পরিচয়পত্র হিসেবে বাধ্যতামূলক ছিল না। তবে বর্তমানে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসাবে স্বীকৃত। স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে চাকরি, পাসপোর্ট বা বিবাহ নিবন্ধন—প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকমের প্রমাণপত্রের প্রয়োজন হত। তবে ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হওয়া জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০২৩ সেই চিত্রটাই বদলে দিল। এখন থেকে জন্ম সনদই হবে বয়স ও পরিচয়ের প্রধান এবং একমাত্র স্বীকৃত নথি। এছাড়াও নাগরিকত্ব প্রমাণে আর গুরুত্বপুর্ন নথি।

জন্ম সনদের বাধ্যতামূলক ব্যবহার
নতুন আইনে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, সরকারি চাকরি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার তালিকাভুক্তি, আধার কার্ড প্রাপ্তি, বিবাহ নিবন্ধন কিংবা পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে জন্ম সনদ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক। এর ফলে নাগরিক জীবনের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে জন্ম সনদের প্রয়োজন হবে। যারা এর আগে অন্যান্য নথি ব্যবহার করতেন, তাদেরও ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তাই জন্ম সার্টিফিকেট সকলের থাকা বাধ্যতামূলক।
ডিজিটাল ডাটাবেসে সংরক্ষিত তথ্য
এবার থেকে দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্ম ও মৃত্যুর তথ্য কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে সংরক্ষিত হবে। রাজ্য সরকারকে এই তথ্য সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (CRS) পোর্টালে আপলোড করতে হবে এবং সেই তথ্য ব্যবহার করে জাতীয় পর্যায়ে একটি একক ডাটাবেস তৈরি করা হবে। এর ফলে নাগরিকদের পরিষেবা দেওয়া আরও দ্রুত ও স্বচ্ছ হবে। একইসঙ্গে ভুয়া নথি বা দ্বৈত নিবন্ধনের সুযোগও অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে।
ডিজিটাল জন্ম সনদ ও অনলাইন সুবিধা
আগে জন্ম সনদ পেতে অনেককে সরকারি দপ্তরে ঘুরতে হত। কিন্তু নতুন আইনে নাগরিকরা অনলাইনে আবেদন করে সরাসরি ডিজিটাল জন্ম সনদ ডাউনলোড করতে পারবেন। এই সনদ সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই সমানভাবে বৈধ থাকবে। ফলে কাগজপত্রের ঝামেলা অনেক কমে যাবে। একইসঙ্গে এটি পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে, কারণ কাগজের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।
পাসপোর্ট ও সরকারি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন
সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে। ১ অক্টোবর ২০২৩-এর পর জন্ম নেওয়া প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জন্ম সনদই হবে বয়স প্রমাণের একমাত্র নথি। আগে যারা জন্মেছেন তারা এখনও স্কুল ছাড়পত্র, প্যান কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহার করতে পারবেন, কিন্তু নতুন প্রজন্মের জন্য বিকল্প কোনো সুযোগ থাকবে না। এই পরিবর্তন পাসপোর্ট আবেদন প্রক্রিয়াকে আরও সুনির্দিষ্ট করে তুলবে।
নিবন্ধনের নতুন দায়িত্ব ও প্রক্রিয়া
নতুন আইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির তালিকা আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। দত্তক সন্তানদের ক্ষেত্রে দত্তক পিতামাতা, সারোগেসির মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে জৈবিক পিতামাতা এবং একক পিতামাতা বা অবিবাহিত মায়ের ক্ষেত্রেও নিবন্ধন করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এর ফলে সমাজের প্রান্তিক ক্ষেত্রগুলোও অন্তর্ভুক্তির সুযোগ পাবে। পাশাপাশি জন্মের ২১ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জন্মের সময় যদি শিশুর নাম ঠিক না করা হয়, তাহলে পরবর্তীতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নাম যুক্ত করার সুযোগ থাকবে।
ধর্ম ও অন্যান্য তথ্যের সংযোজন
একটি নতুন পরিবর্তন হল, জন্ম নিবন্ধন ফর্মে বাবা ও মায়ের ধর্ম আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হবে। এই তথ্য ভবিষ্যতে সরকারি রেকর্ডে সংরক্ষিত থাকবে। এর ফলে দেশের জনসংখ্যা ও সামাজিক তথ্য সংগ্রহ আরও বিস্তারিত ও সঠিক হবে। যদিও এ নিয়ে গোপনীয়তা ও তথ্য ব্যবহারের প্রসঙ্গে কিছু বিতর্কও তৈরি হয়েছে।
নাগরিক জীবনে পরিবর্তনের প্রভাব
এই আইনের প্রভাব প্রত্যেক নাগরিকের জীবনে সরাসরি পড়বে। স্কুলে ভর্তি হতে গেলে আর জন্মতারিখ প্রমাণে বিভিন্ন কাগজের দরকার হবে না, কেবল জন্ম সনদই যথেষ্ট। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বয়স যাচাই বা পেনশন সুবিধার জন্য জন্ম সনদই হবে চূড়ান্ত প্রমাণ। ফলে একদিকে নাগরিকরা পাবেন সুবিধা ও ঝামেলামুক্ত প্রক্রিয়া, অন্যদিকে নথির সত্যতা যাচাই সহজ হবে।
কেন এই পরিবর্তন জরুরি
ভারতের মতো জনবহুল দেশে জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক রেকর্ড রাখা অত্যন্ত জরুরি। এতদিন পর্যন্ত রাজ্যভিত্তিক তথ্য আলাদাভাবে সংরক্ষিত থাকত, ফলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অনেক তথ্য অস্পষ্ট থেকে যেত। নতুন আইনে একক ডাটাবেস তৈরি হওয়ায় সরকারি নীতি নির্ধারণ, জনসংখ্যা গণনা, স্বাস্থ্যসেবা পরিকল্পনা বা কল্যাণমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে তা বড় ভূমিকা নেবে। একইসঙ্গে নাগরিকদেরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচয়পত্রের ঝামেলা থেকে মুক্তি মিলবে।
জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন, ২০২৩ নিঃসন্দেহে ভারতের প্রশাসনিক ইতিহাসে একটি বড় পদক্ষেপ। জন্ম সনদ এখন থেকে নাগরিক জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় নথি হয়ে উঠবে। এই পরিবর্তন যেমন পরিষেবা পাওয়া সহজ করবে, তেমনি সরকারের নীতি প্রণয়নেও সঠিক তথ্য যোগান দেবে। তাই প্রত্যেক নাগরিকের উচিত সময়মতো জন্ম নিবন্ধন করা এবং নতুন নিয়ম সম্পর্কে সচেতন থাকা। না হলে ভবিষ্যতে শিক্ষা, চাকরি, বিবাহ বা পাসপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় জটিলতায় পড়তে হতে পারে।

SGL Team
We are a group of passionate journalists, writers, and content creators dedicated to bringing our readers reliable, fact-checked, and insightful news. Our team works collectively to ensure that every article published reflects accuracy, neutrality, and journalistic integrity.




